রাজধানীর যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকার ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেতে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং।
কিন্তু এই সেবার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ার সাথে সাথে একশ্রেণির চালকের চতুরতা ও নতুন নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয়ায় হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। অ্যাপে নয়, দরদাম করে বনিবনা হলেই কেবল চালকেরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রী পরিবহন করতে রাজি হচ্ছেন। যাত্রীদের নিত্যদিনের এই দুর্ভোগের চিত্র এখন পুরো রাজধানীতেই চোখে পড়বে। কিছুকিছু চালক কোনো রাইড শেয়ারিংয়ের আওতায় রেজিস্ট্রেশন না করেই বাড়তি একটি হেলমেট নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছেন মোটরসাইকেল নিয়ে। এসব চালকের অবশ্য অ্যাপে যাওয়ার কোনো সুযোগও নেই। তাই তারা যাত্রীর সাথে চুক্তির মাধ্যমেই চলাচল করেন। শুরুর দিকে হাতেগোণা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও রাজধানীতে এখন বেশ কয়েকটি কোম্পানির অধীনে রাইড শেয়ারিংয়ের পরিবহন সেবা দেয়া হচ্ছে। পাঠাও, উবার, ওভাই, সহজ, পিকমি নামের কোম্পানির অধীনেই মূলত প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, এমনকি বাইসাইকেলও নাগরিকদের পরিবহন ও পার্সেল সেবা দিচ্ছে।
এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচার রয়েছে ‘পাঠাও’-এর। পাঠাওয়ের মার্কেটিং বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, নির্দিষ্ট অ্যাপসের বাইরে গেলে চালক ও যাত্রী দু’জনের জন্য ঝুঁকি থাকে। কেননা অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিংয়ের সেবা গ্রহণ করলে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। কারণ সেবা গ্রহণের শুরুর সময় থেকে যাত্রী তার গন্তব্য পৌঁছানো পর্যন্ত যাত্রীর সার্বিক রেকর্ডটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রতিষ্ঠানের কাছে রেকর্ড থাকে। তাই তারা যাত্রীদেরকেও সতর্ক করে এই বার্তাটিই দেয়ার চেষ্টা করে, যাতে যাত্রীদের নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই অ্যাপের বাইরে গিয়ে এই সেবা গ্রহণ না করেন। যদি অ্যাপ ব্যবহার করে যাত্রী পরিবহন করা হয়, তা হলে যাত্রী ও চালক উভয়েরই নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। কেননা অ্যাপের মাধ্যমে চালক ও যাত্রী দু’জনেরই মোবাইল নম্বর সংরক্ষিত থাকে। এ ছাড়া সময় এবং গন্তব্যও স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড থাকে। কিন্তু অ্যাপের বাইরে গেলে কারোরই কোনো তথ্য সংরক্ষিত থাকে না।
কাজেই জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টিকেও যদি গুরুত্ব দেয়া হয় তা হলে অ্যাপের বাইরে যাওয়া চালক ও যাত্রী কারো জন্যই নিরাপদ হবে না। তবে এ বিষয়ে যাত্রীদেরও অনীহা রয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমে রাইড ডাকাকে অনেকেই ঝামেলা মনে করেন সেজন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা চালকদের সাথে চুক্তি করে গন্তব্যে যান। কিন্তু এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে ভাবেন না অনেকেই। এদিকে যাত্রীদের অভিযোগ, অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল চালকদের বেশিরভাগই অদক্ষ। যাত্রীসেবার ব্যাপারে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই। তবু যানজট ও গণপরিবহন সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীরা এসব মোটরসাইকেলে যাতায়াত করছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের অভাবে এতে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা, বাড়ছে ভোগান্তি। চালক ও অ্যাপ র্কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, যাত্রী পরিবহন শুরুর আগে মাত্র ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শেয়ারিং রাইড ব্যবহারকারী যাত্রীরা বলছেন, ঢাকায় মোটরসাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা নেই এমন চালকই বেশি। তাদের অনেকে ট্রাফিক আইনই জানে না। বেশি ভাড়া আদায়ে অনেক চালক চুক্তিতে যেতে আগ্রহী, আবার অ্যাপ নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে বেশি ভাড়াও দাবি করেন। এ ছাড়া বেশিরভাগ মোটরসাইকেলে যাত্রীর জন্য থাকা হেলমেট নিরাপদ নয়।
অন্যদিকে চালকদের অভিযোগ, অ্যাপ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে ২৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয়, এটা অনেক বেশি। এ ছাড়া যাত্রীকে তোলার জন্য কোনো গন্তব্যে যেতে হয় না, যাত্রীরাই তাঁদের কাছে আসেন। অন্যদিকে যাত্রীরা বলছেন, অ্যাপে সব সময় মোটরসাইকেল পাওয়া যায় না। তাই চালকদের শর্তানুযায়ী যেতে বাধ্য হতে হয়। শুরুতে দামাদামি করে কিছুটা কম ভাড়ায় যাওয়া যেত। এখন চালকেরা অনেকটা সিন্ডিকেটের মতো ভাড়া ঠিক করেছেন, সেই ভাড়াতেই যেতে হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেগাসিটিগুলোতে যানজট এড়াতে দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও অলস পড়ে থাকা গাড়ি দিয়ে বাড়তি আয় করা রাইড শেয়ারিংয়ের উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলাদেশে লাখো বেকার যুবক রাইড শেয়ারিংকে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে নিয়েছেন।
তবে সরকারের নজরদারি না থাকায় সম্ভাবনার এ খাতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের একটি সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন চার লাখেরও বেশি চালক। ২০১৬ সালের শেষে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উবার বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে এ দুটো কোম্পানি সিংহভাগ বাজার দখল করে রেখেছে।
এ ছাড়া ওভাই, পিকমি, ডিজিটাল রাইড, সহজসহ ১০টির মতো রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত সংশ্লিষ্টদের অক্ষমতার জন্য রাইড শেয়ারিংয়ের মতো পরীক্ষিত খাত এলোমেলো হয়ে পড়েছে। এটা এখন না রাইড শেয়ার না চুক্তিভিত্তিক, অগোছালো জিনিস হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এ খাতে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা ভর করেছে।
বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করেছে। এটাকে প্রকৃতপক্ষে রাইড শেয়ার বলা যায় না। রাইড শেয়ারিং এখানে বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে। এখানে স্পষ্ট বাণিজ্যিক নীতিমালা প্রয়োজন ও হয়রানি থেকে যাত্রীদের মুক্তি দিতে গাইডলাইন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।