আলুবীজের উচ্চমূল্য ও সার সঙ্কটে বিপাকে কৃষক। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) বীজের দাম প্রতি কেজি ৫৭ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাজারে ওই দামে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্র্যাক ও কিষাণ সিডসহ কিছু কোম্পানির বীজ বাজারে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এমনিতেই বিএডিসি ও হিমাগারে সংরক্ষিত আলুবীজের প্রতি কৃষকের আগ্রহ কম। বরং বেশির ভাগ আলুচাষী সাধারণত হল্যান্ড থেকে আমদানি করা বীজের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু ওই বীজ কৃষক পর্যায়ে পৌঁছতেই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে দাম।
৫০ কেজির এক বাক্স আলু আমদানিতে যেখানে খরচ পড়ছে ১৩ হাজার টাকা, কৃষক পর্যায়ে তা বিক্রি হচ্ছে ২৬ হাজার টাকায়। অথচ গত বছর একই বীজ ১১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। কৃষক এবং কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আমদানি করা বীজের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। আমদানিকারকের কাছ থেকে ডিলারের হাত হয়ে কৃষক পর্যায়ে পৌঁছতেই বীজের দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাচ্ছে। বিক্রয় রসিদে দাম ১৩ হাজার টাকা উল্লেখ থাকলেও কৃষকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ২৬ হাজার টাকা। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে কৃষক পর্যায়েই আলুর দাম হবে ৮০ টাকা কেজি।
মূলত ডিলাররা আমদানি করা বীজের প্রতি কৃষকের আগ্রহকে পুঁজি করছে। যদিও চলতি আলুেে মৗসুমের শুরুতে ১৬-১৮ হাজার টাকায় বীজ বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন দাম অনেক বেড়ে গেছে। সূত্র জানায়, দেশে সর্বোচ্চ আলু উৎপাদনকারী একটি জেলা হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ। চলতি মৌসুমে মুন্সিগঞ্জে ৩৪ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা থেকে ১০ লাখ ৪৫ হাজার টন আলু উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ৭৩ হেক্টর জমিতে আলু রোপণ শেষ হয়েছে। সিরাজদিখান উপজেলায় গত বছর আলু রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ হাজার ৭৫৫ হেক্টর।
এ বছর আবাদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার হেক্টর। সব মিলিয়ে এ বছর বীজের চাহিদা রয়েছে ৭৬ হাজার টন। এর মধ্যে জেলার ৫৮টি হিমাগারে ৪৪ হাজার টন বীজ মজুদ রয়েছে। ওই জেলায় চার-পাঁচজন আলুবীজ আমদানি করেন। প্রতি বাক্স বীজের দাম পড়ে ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে তা অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হচ্ছে। মূলত ডিলাররা কারসাজি করে আলুবীজের দাম বাড়াচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ডিলারদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের বৈঠক হয়েছে। সেখানে কৃষকের কাছে প্রতি বাক্স হল্যান্ডের আলুবীজ ১৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করার কথা জানিয়েছেন ডিলাররা। কিন্তু বাস্তবে ডিলাররা বেশি দামে বীজ বিক্রি করছে। এখন ওসব ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে মুন্সিগঞ্জ জেলায় বীজ বিক্রির খুচরা পর্যায়ে কতজন ডিলার রয়েছে তার তালিকা কৃষি বিভাগে নেই। তবে তিনটি আমদানিকারক এজেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে একটি এজেন্টের বীজ বাজারে এসেছে। বাকি দুটি এজেন্টের বীজ এখনো আসেনি। বীজ আমদানির হিসাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, আলু চাষাবাদের ভরা মৌসুমে দেশের কোনো কোনো অঞ্চলের কৃষক সার নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। সার সংগ্রহ করতে গিয়ে চাষিদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। একই সঙ্গে গুনতে হচ্ছে বেশি টাকা। চাষিদের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতারা ডিলারদের বরাদ্দ থেকে অধিকাংশ সার নিয়ে যাচ্ছে। আবার ওই সার চাষিদের কাছে তারা বেশি দামে বিক্রি করছে।
সার ডিলারদের দাবি, তারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে চাষিদের ঠিকমতো সার দিতে পারছেন না। যদিও বাজারে আলুর চড়া দামের কারণে এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। তাই আমন ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে জমি তৈরি করছেন চাষিরা। আর আলুবীজ সংকটের মধ্যে এবার চাষিদের সার কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোথাও চাহিদামতো সার পাচ্ছে না তারা। ক্ষেত্রবিশেষে বস্তা প্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে বেশি দিয়ে তাদের সার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। ফলে আলু আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে সার ডিলার মতে, এবার চাহিদার তুলনা সারের বরাদ্দ কিছুটা কম। পাশাপাশি হঠাৎ করেই স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতাদের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা দলের পরিচয় দিয়ে ডিলারদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে সার নিচ্ছে। তারা চাষি কিনা সেটাও বোঝা যায় না। দেশের রাজশাহী জেলাজুড়ে বিসিআইসি অনুমোদিত ২১৯ জন সার ডিলার আছে। অন্যদিকে বিএডিসি অনুমোদিত ডিলারের সংখ্যা ১৩০ জন। বিসিআইসির ওসব ডিলারের মাধ্যমে পটাশ, টিএসপি, ডিএপি ও ইউরিয়া সার বিতরণ করা হয়। রাজশাহীর মোট ৩৪৮ জন ডিলারের মধ্যে চলতি নভেম্বর মাসে ২ হাজার ৮০৬ মেট্রিক টন টিএসপি ও ৫ হাজার ৪৩২ মেট্রিক টন এমওপি সার বরাদ্দ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চলতি মাসের সব সারই উত্তোলন সম্পন্ন হয়েছে। তবে এরপরও সারের সংকট কাটেনি।
এদিকে আলুবীজের উচ্চমূল্য প্রসঙ্গে মুন্সিগঞ্জ কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর বীজ আমদানি অর্ধেক কমেছে। তাই হয়তো দাম একটু বেশি। তবে প্রতিদিন দাম তদারক করা হচ্ছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের টিমও এ নিয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে সার সঙ্কট বিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক উম্মে ছালমা জানান, চলতি আলু আবাদে চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী সার বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে কোথাও বিতরণে কোনো সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। তা নিবিড় তদারকির মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে।