আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। ফলে যে চাহিদা থাকে তার তুলনায় কম পণ্য কিনে কোনোরকমে দিনযাপন করছেন অনেকে।
আগস্টে ক্ষমতার এ পালাবদলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হামলা-মামলা, বেশকিছু শিল্পে নৈরাজ্য, অস্থিরতা আর উৎপাদনের স্থবিরতাসহ নানান কারণে একটি বড় অংশের মানুষের আয় কমেছে। বিশেষ করে আতঙ্কে আছেন হাজারো কর্মী। কাজ হারানোর শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের। তারা এখন খরচ কমিয়েছেন।
এ ছাড়া সরকার ও রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগীদের একটি অংশেরও এখন আয় নেই। এদিকে ক্ষমতার পালাবদলে শিল্পে নৈরাজ্য, অস্থিরতা আর উৎপাদনের স্থবিরতার মধ্যে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে বলে মনে করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক, সেপ্টেম্বর ২০২৪’ এর প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, মূল্যস্ফীতি ধারণার চেয়েও বেশি বাড়বে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ১ শতাংশ হবে। এই পূর্বাভাস গত এপ্রিলে দেওয়া পূর্বাভাসের চেয়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপর থাকলেও তা আগস্ট মাসের তুলনায় কমেছে। সেপ্টেম্বর মাসে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, ২০২৩ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০২২ সালের আগস্টে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ মূল্যস্ফীতি কমানোই এখন অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে হবে। সম্প্রতি খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বলা হয়, চড়া মূল্যস্ফীতি আর লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে ধারদেনা করে দেশের চার কোটি মানুষ খাবার কিনছে। আর জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) হিসাবে, গত আগস্টে দেশের নিম্ন আয়ের ৩৮ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে। আর দরিদ্রদের ৪৩ শতাংশ ধার করে খাবার কিনে খাচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক চাপ ও মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমে গেছে।
এ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী বাজারদরের কারণে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে না পেরে মধ্য ও নিম্ন আয়ের সব পরিবার দিশাহারা হয়ে পড়েছে। তাই সংকট কাটাতে সঠিক পরিকল্পনা ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বাড়ানোর তাগিদ তাদের। একই সঙ্গে ভোক্তাদের স্বার্থে অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠোরভাবে দমন করা হলে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা কমবে বলে মনে করেন তারা। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশি চাপে রয়েছে উল্লেখ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজির হোসাইন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় নিত্যদিনের খাবার খরচ কমিয়ে ব্যয়ের সমন্বয় করছেন। আবার অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা বারবার কঠোরভাবে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য বলেছি।
যদিও বর্তমান সরকার অনেক চেষ্টা করছে; কিন্তু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সবসময় একটা না একটা অজুহাত দিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের চোর-পুলিশ খেলা চলছে। আমরা আশা করছিলাম যেহেতু আগের সরকার নেই, তাই রাজনৈতিক প্রভাব নেই। কিন্তু নতুন সরকার এলেও প্রশাসন কিন্তু আগেরই রয়ে গেছে। আমলারা বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা লুট করাতে এবং পাচারে সাহায্য করেছেন।
প্রশাসনে এখনও তারা বহাল আছেন। ফলে তাদের মাইন্ডসেট একই থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা যা খুশি তাই করছে। আর এখন তো আইনের প্রয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে না। কারণ বাজারে এখনও এজেন্ট প্রথা চালু রয়েছে। এর মানে হলো দালালি। ফলে যখনই কোনো পণ্য হাতবদল হয় তখনই দাম বাড়ে। আর ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। তাই বাজারে শুধু শুল্ক কমালে হবে না, মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমবে। গত এক যুগের মধ্যে শেষ অর্থবছরে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপ ছিল মূল্যস্ফীতির। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
সে চাপটা এখনো অব্যাহত। এজন্য নতুন সরকার কিছু উদ্যোগ নিলেও সেটার সুফল সাধারণ মানুষ পায়নি। কীভাবে নিত্যপণ্যের দাম কমানো যাবে, সেদিকেই নজর দিতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা। তিনি বলেন, বেশ আগে থেকে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে, তখন সরকার যতটুকু বলেছে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি ছিল। এখনো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা বলেন, এ সুযোগে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে সিন্ডিকেট, যা অনেক দিন ধরেই দেশে চলছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও সাধারণ মানুষ বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারছে না।
নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা খুব বিপদে রয়েছে। তারা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, সম্প্রতি দেশের একটি সরকার চলে গেলো, যাদের নানান পরিকল্পনা ছিল, কম-বেশি যা হোক অর্থনীতি একটা গতিতে ছিল। সেটা এখন বন্ধ। এখন নতুন করে সব হচ্ছে, কোম্পানিগুলোর নতুন চুক্তি, নতুন সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়ন- সেটার জন্যও একটু সময় লাগবে। তিনি বলেন, মানুষজনও এখন কিছুটা বিশৃঙ্খল রয়েছে, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সব জায়গায়।
তারাও একটু গুছিয়ে নিচ্ছে, খরচ দেখেশুনে করছে। যতটুকু না হলে নয়। মিজানুর রহমান আরও বলেন, এছাড়া বিগত সরকারের সময় অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা ছিল। ব্যাংক, গার্মেন্টস, আমদানি-রপ্তানিতে স্থবিরতা ছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সেগুলো স্বাভাবিক হতে আরও দু-চারমাস সময় লাগবে।