টানা এক-দেড় ঘন্টা বৃষ্টি হলেই বোঝা যায় ঢাকার পানি নিষ্কাষন ব্যবস্থা কতটা নাজুক।
বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক, অলিগলি ও ফুটপাত ডুবে যায়। ফলে নগরবাসীকে হাঁটুসমান দুর্গন্ধময় কালো পানি ভেঙে গন্তব্যে যেতে হয়। বিভিন্ন কাজে যাতায়াতকারীদের দুর্দশার শেষ থাকে না। বৃষ্টির পানি জমে শুধু ভোগান্তি নয়, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। গত বছর মিরপুরে কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায় বৃষ্টিতে জমা পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের চারজন মারা যান।
এ ঘটনার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলেও বর্ষাকাল যেতেই মানুষ ভুলে গেছে। সেই জলাবদ্ধতারও কোনো সুরাহা হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র বলেছিলেন, এবার বর্ষায় নগরে কোনো জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে না। ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রও বিভিন্ন সময় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তবে এসব কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে নাগরিকদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মে মাসের শেষের দিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে রাজধানীতে টানা বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। পর্যবেক্ষকদের মতে, ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেশির ভাগ অকার্যকর। ড্রেনগুলো প্রায় সারা বছর ময়লা-আবর্জনায় ভরাট থাকে। সিটি করপোরেশনের সেদিকে খেয়াল থাকে না। এছাড়া এক সময় ঢাকায় অনেক খাল ছিল, জলাশয় ছিল, পুকুর ছিল।
এসবের মাধ্যমে পানি নিষ্কাষন হয়ে যেতো সহজেই। প্রাকৃতিকভাবে পানি নিষ্কাষণের এ ব্যবস্থা এখন নেই বললেই চলে। অধিকাংশ খাল দখল হয়ে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। জলাশয়গুলোর বেশির ভাগের অস্তিত্ব নেই। এগুলো দখল-ভরাট ও এর ওপর বাড়ি-ঘর-স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। পুকুরের প্রায় সবই হারিয়ে গেছে। জানা যায়, ঢাকার সবুজ ও জলাশয়ের ৩১ শতাংশ দখলের শিকার হয়েছে, যেগুলো উদ্ধারের উদ্যোগ নেই। ঢাকা জেলা প্রশাসন ঢাকার ৬২টি পুকুরের ওপর একটি জরিপ চালায়। সেই জরিপে দেখা যায়, ৬২টি পুকুরের মধ্যে ৫০টির এখন আর অস্তিত্ব নেই। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হলে খাল, জলাশায় ও পুকুর পুনরুদ্ধার অত্যাবশ্যক। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে তাকিদ উচ্চারিত হলেও তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় ২৬টি খাল আছে, যার কয়েকটিতে সংস্কার শুরু হয়েছে মাত্র। শ্যামপুর, জিরানী, মান্ডা ও কালুনগর খাল উদ্ধারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ সবই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় আছে ২৯টি খাল, যার কিছু উদ্ধারের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। তবে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। প্রতি বছর জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে সংস্থা দুটি। কিন্তু তার তেমন কোনো সুফল মিলছে না। বৃষ্টি হলেই নগরের প্রধান সড়ক থেকে অলি-গলি পর্যন্ত তলিয়ে যাচ্ছে পানিতে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবারের বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হলে জলাবদ্ধতায় আরও নাকাল হবে নগরবাসী।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে তারা আরও মাসখানেক আগ থেকেই কাজ শুরু করেছেন। এখন সম্ভাব্য জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকাগুলোর ড্রেন, নালা, খাল পরিষ্কারে কাজ চলছে। আর যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা বেশি হয়, তা সমাধানে আলাদা প্রকল্প নিচ্ছে সংস্থা দুটি। যদিও বিদ্যমান জনবল দিয়ে ঢাকার সব এলাকা জলাবদ্ধতামুক্ত রাখা সম্ভব নয় বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। একই সঙ্গে তারা আলাদা একটি জলাবদ্ধতা নিরসন বিভাগ চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। পাশাপাশি বিভাগ পরিচালনায় পর্যাপ্ত জনবলও চেয়েছে।
ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, ডিএনসিসি এলাকায় ১২শ ৫০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে এসব ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে। ডিএনসিসি ইব্রাহিমপুর, লাউতলা, কল্যাণপুর, রূপনগর, আব্দুল্লাহপুর, সিভিল অ্যাভিয়েশন, বাইশটেক, বাউনিয়া, প্যারিসসহ ২৯টি খালের বর্জ্যও অপসরণ করা হয়েছে। তারপরও কোথাও জলাবদ্ধতা হলে তাৎক্ষণিক ডিএনসিসির কুইক রেসপন্স টিম কাজ করবে। তবে খালে, ড্রেন, নালায় প্লাস্টিকের বোতলসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ফেলার কারণে বর্ষায় জলাবদ্ধতা হয় বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগে বৃষ্টি হলে শহরে যে পরিমাণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো সেটা অনেকাংশে সমাধান হয়েছে। একসময় বিভিন্ন প্রধান সড়কেও কয়েকদিন জলাবদ্ধতা থাকতো।
এখন আর প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতা হয় না। অল্প সময়ের মধ্যেই পানি ড্রেন, নালা গড়িয়ে খাল-নদীতে চলে যায়। অন্যদিকে ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে তারা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে শাখা-প্রশাখাসহ ১১টি খাল বুঝে নেয়। এসব খাল থেকে ক্রমান্বয়ে সব বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। এখনো খালগুলোতে পানি প্রবাহ রাখতে নিয়মিত পরিষ্কার রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া বক্স-কালভার্ট ও নর্দমা পরিষ্কার করা হচ্ছে নিয়মিত। এদিকে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে জনবলসংকট কাটাতে নতুন পদ সৃষ্টির কথা থাকলেও সেটি বেশিদূর এগোতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে গত বছর জুলাইয়ে ডিএসসিসি ‘জলবদ্ধতা নিরসন শাখা’ নামে নতুন একটি বিভাগে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়ে মোট ১১৪টি পদ এবং বাজার, বিপণিবিতান নির্মাণ ও সংস্কার শাখার রাজস্ব খাতে ১৪টিসহ মোট ১২৮টি পদের একটি প্রস্তাবনা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। আর ডিএনসিসি ‘ড্রেনেজ সার্কেল’ নামে একটি বিভাগে ২৬৫টি ও সিটি স্যানিটেশন সেলে ৬৯টি পদ তৈরির প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায় গত অক্টোবরে। এরপর গত মার্চে ডিএনসিসি ড্রেনেজ সার্কেলে ১৯৬টি এবং সিটি স্যানিটেশন সেলে ৬৬টি পদ তৈরির সংশোধিত প্রস্তাব পাঠায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। তবে এখনো তা চূড়ান্ত অনুমোদন হয়নি।