নির্বাচনের পরে বাজারে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। চাল, আটা, তেল, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম চড়া।
সামনে আসছে পবিত্র শবে বরাত ও রমজান মাস। এবার রমজানের দেড় মাস আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। এবারও তেমন ইঙ্গিত আগেভাগেই পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকলেও রমজানের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলির দাম সারা দেশে বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি, ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, শুকনো মটর, পেঁয়াজ, খেজুর, মাংস, মুগের ডাল, রসুন, আদা, ময়দা ইত্যাদির মতো নির্দিষ্ট আইটেমগুলির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি-অর্থনীতিবিদ এবং গবেষক ডঃ জাহাঙ্গীর আলম খান পাইকারি বাজারের কারসাজির বিরুদ্ধে সরকারের অপর্যাপ্ত বাজার মনিটরিং এবং নজরদারিকে মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও অসাধু ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রমজানের প্রত্যাশায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়েছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ মেয়াদে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে মসুর ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন এবং আদা আমদানি করেছে। আগের বছরের তুলনায় আমদানিকৃত চিনি, অপরিশোধিত ভোজ্যতেল, ছোলা, পেঁয়াজ এবং মসুর ডাল উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সাথে আমদানিতে বৃদ্ধি স্পষ্ট। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন, যেখানে শুধু ছোলার চাহিদা থাকে প্রায় ১ লাখ টন। পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন, আনুমানিক বার্ষিক ছোলার চাহিদা ১.৪০ লাখ টন, যা বার্ষিক বাড়তে থাকে। কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন মূল্যবৃদ্ধির জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফা-চালিত অনুশীলনকে দায়ী করেছেন। তিনি দামের হেরফের রোধে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত সরবরাহ শৃঙ্খলা জুড়ে আরও সক্রিয় সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ সালে রসুন, মসুর ডাল, ছোলা এবং পেঁয়াজের স্থানীয় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে যা আমদানি নির্ভরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এসএম নাজের হোসেন বলেন, রমজানে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কয়েক মাসের জন্য তুলে দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, “সরকারের উচিত আমদানি মূল্য ও অন্যান্য খরচ বিশ্লেষণ করে আমদানিকৃত পণ্যের পাইকারি ও খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা। এ ছাড়া সরকারের উচিত ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে পণ্যের দাম প্রচার করা। তিনি আরও বলেন, প্রচারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী পণ্য বিক্রি করছে কিনা তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্ধিত আমদানি নির্ভরতা দেশটিকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের ওঠানামার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে, বিশেষ করে অস্থিতিশীলতার সময়কালে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সাম্প্রতিক মূল্যের তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে ময়দা, মসুর ডাল, মুগ ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, গরুর মাংস এবং ব্রয়লার মুরগির মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। আদা, রসুন, মুরগির মাংস, ডিম, চিনি, ছোলা এবং ময়দার দাম বিগত বছরে দামের তুলনা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির পেয়েছে। একটি প্রাইভেট কোম্পানির কর্মচারী তাসকিন আহমেদ, দামের ক্রমাগত বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, রমজান ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে, সাধারণ নাগরিকদের আর্থিক চাপ বেড়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় অনেক নাগরিকদ ভাবছেন কীভাবে তারা সামনের অর্থনৈতিক চাপ মোকাবেলা করবেন।
টিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী মূল্য বৃদ্ধি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি)’র তথ্য অনুযায়ী গত এক মাসের মধ্যে খোলা আটার দাম ৮.৪২% বেড়েছে আর প্যাকেট আটার দাম ৪.৩৫% বেড়েছে, টিসিবির তথ্য অনুসারে দাম যথাক্রমে প্রতি কেজি ৪৮-৫৫ টাকা এবং প্রতি কেজি ৫৫-৬৫ টাকা। খোলা ময়দার দাম এক মাসে ৩.৮৫% বৃদ্ধি পেয়েছে, প্যাকেট করা ময়দা ৩.৫৭% বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে প্রতি কেজি ৬৫-৭০ টাকা এবং প্রতি কেজি ৭০-৭৫ টাকায় পৌঁছেছে। মসুর ডালের দাম এক মাসে ১.৮৯% বেড়েছে, যা প্রতি কেজি ১৩০-১৪০ টাকায় পৌঁছেছে। তবে গত বুধবার মিরপুর-১৩, মিরপুর-১২, মিরপুর-১১ ও শেওড়াপাড়ার খুচরা দোকানে স্থানীয় মসুর ডাল ১৫০ টাকা কেজি এবং ছোলা বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা কেজি দরে।
টিসিবির তথ্য অনুসারে, এক মাসে মুগ ডালের দাম ২১.৫৭% বেড়েছে, এংকর ডাল ৪.১৭% এবং ছোলা ৫.৪১% বেড়েছে। যা যথাক্রমে প্রতি কেজি ১৩০-১৮০ টাকা, প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকা এবং ৯৫-১০০ টাকা দাম পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় পেঁয়াজের দাম ২.৭৮% বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি কেজি ৯০-১০০ টাকা, গরুর মাংসের দাম ১১.৫৪% বেড়ে প্রতি কেজি ৭০০-৭৫০ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগির দাম ৫.৪১% বেড়ে প্রতি কেজি ১৯০-২০০ টাকা হয়েছে। আগের বছর রমজানের এক মাস আগে আমদানি করা আদার দাম ছিল প্রতি কেজি ২৮০ টাকা, স্থানীয় আদার দাম ছিল ১৮০ টাকা। আমদানি করা রসুনের দাম প্রতি কেজি ৪০ টাকা এবং দেশি রসুন ৩৫ টাকা কেজি। একইভাবে আগের বছর রমজানের এক মাস আগে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৫০-১৫৫ টাকা কেজি, ফার্মের ডিমের দাম ছিল ৯০ টাকা প্রতি ডজন, চিনি ৭৮-৮০ টাকা কেজি, ছোলা ৮০-৮৫ টাকা কেজি, এংকর ডাল ৭০ টাকা, খোলা চিনি ১১৫-১২০ টাকা কেজি এবং আলু ২০-২৫ টাকা কেজি। এ ছাড়া আগের বছর রমজানের এক মাস আগে খোলা সাদা আটা প্রতি কেজি ৫৮-৬০ টাকা, প্যাকেট আটা ৬৫-৭০ টাকা কেজি, দেশি পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।